১৫ই আগস্ট

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ ফজলে শামস পরশের বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর আর তার ছোট ভাই শেখ ফজলে নূর তাপসের বয়স ছিল সাড়ে চার। পনেরোই আগস্ট রাতের কিছুটা ধোঁয়াটে স্মৃতি এখনও পরশের মনে আছে কিন্তু তাপসের নেই। সেই রাতে, বাইরে হট্টগোলের শব্দে দুই ভাইয়ের একসাথে ঘুম ভেঙে যায়। দুই ভাই, বড় ভাইয়ের পিছু পিছু ছোট ভাই, ঘর থেকে বের হয়। ছয় বছরের পরশের স্মৃতিতে দোতালার ল্যান্ডিংয়ে রক্তের পুলের মধ্যে শুয়ে আছেন তাদের বাবা-মা। তাদের বাবা শেখ মনি নিচে আর তার উপর পারপেন্ডিকুলার অবস্থায় তাদের মা, আরজু মনি সেরনিয়াবাত। এরপরের কয়েক বছর দুই ভাইকে নিয়ে লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে। সময় পার হতে থাকে—খাবার, ঘুম, আশ্রয়ের নিশ্চয়তা নেই। এক পর্যায়ে, লুকিয়ে তাদের বর্ডার ক্রস করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও তাদের যত্ন নেওয়ার মতো কেউ ছিল না, ফলে কিছুদিন পর আবার দেশে ফিরে আসতে হয়। তখন বলা হচ্ছিল, পরশ ও তাপস নিরাপদ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমস্যা থেকেই যায়। শেখ মনির সন্তান আর আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের নাতি শুনলে কোনো স্কুল তাদের ভর্তি করতে চায় না। উপরের এই ঘটনাগুলো বলার কারণ হলো, ১৫ আগস্ট শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর দিন নয়, এই দিনে ষোলো জন মানুষ নিহত হন। তিনটি পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

১৫ আগস্টের সমর্থনকারীরা বলে থাকেন, শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন যেখানে তিনি তার দল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল ব্যান করেছিলেন, সরকারি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। তাদের মতে, তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য ননভায়োলেন্ট কোনো পথ ছিল না, কথাটা আসলে ঠিক নয়। পথ ছিল। যদিও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ এবং কর্নেল তাহেরের গ্রুপ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সুযোগ খুঁজছিল এবং প্ল্যান করছিল, সেনাবাহিনী ওই ক্যু না করলেও একটি গণঅভ্যুত্থান হতো—হয়তো অনেক কম রক্তপাতে বা রক্তপাত ছাড়াই সরকার পরিবর্তন হতো। ২০২৪ সাল তা প্রমাণ করে দিয়েছে যে গণঅভ্যুত্থান কি করতে পারে! মানুষ কিভাবে অকাতরে জীবন দিতে পারে।

১৯৭১ পূর্ববর্তী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অপরিসীম। ৭২ পরবর্তী সময়ে তার ভুলত্রুটিগুলো তার করুন মৃত্যু দিয়ে মোচন হয়েছে। যদি তার কোনো পাপ থেকে থাকে, তা ১৫ আগস্টের ম্যাসাকারের মাধ্যমে স্খলিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অস্বীকার করে না এবং তাকে ভালোবাসতে চায়। জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গভবনে শেখ মুজিবের ছবি ছিল। জিয়া যখন প্রথম পঁচাত্তর পরবর্তী পার্লামেন্টের উদ্বোধনী বক্তৃতা দিলেন, তিনি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে স্মরণ করে তার বক্তৃতা শুরু করেন। জিয়াউর রহমান ভারত সরকারকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেন এবং ৩২ নম্বরের বাড়ি বুঝিয়ে দেন। ১৯৮০ সালে থিয়েটারে একটি বাংলা চলচ্চিত্র দেখেছিলাম যেখানে শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ দেখানো হয়েছিল। আমার মনে পড়ে, যখনই এই ভাষণটি বাজত, পুরো থিয়েটার হাততালিতে ফেটে পড়ত। খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান ক্ষমতায় থাকার সময় টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে গিয়েছিলেন। তবে শেখ হাসিনার কাছে শুধু শেখ মুজিবকে ভালোবাসলেই হবে না, মুজিবকে একটি কাল্ট ফিগার হিসেবে পূজা করতে হবে। এখানে কোনো শিরক চলবে না। শুধু শেখ মুজিবকে সম্মান করা যাবে, অন্য কাউকে নয়। তাদেরকে ঘৃণা করতে হবে।

তাই আজ পনেরোই আগস্টের ন্যারেটিভে পরশ-তাপসদের কথা নেই। আজকের যে জেনারেশন শেখ হাসিনাকে টেনে নামালো, মুজিবের শত শত মূর্তি তিন ঘণ্টার মধ্যে ধ্বংস করে ফেললো, সেই জেনারেশনটি ছোটবেলা থেকে শেখ মুজিবকে নিয়ে অধ্যায় মুখস্থ করতে হয়েছে। ওদের ইতিহাস শিক্ষায় মাওলানা ভাসানী নেই, তাজউদ্দীনের কোনো উল্লেখ নেই।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সেই বাড়ি যেখানে জিয়াউর রহমান ১৯৭২ সাল থেকে ছিলেন এবং মৃত্যুর পর পর্যন্ত যেখানে খালেদা জিয়া ছিলেন, সেই বাড়িটি শেখ হাসিনা বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেন। শেখ হাসিনা যে মুজিবের গড লাইক পারসোনা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, সেই পারসোনা নার্চার করার জন্য জিয়াউর রহমানকে শুধু ইতিহাস থেকে উচ্ছেদ করলেই হবে না, তার বাড়ি গুঁড়িয়ে দিলেই হবে না, তাকে জাতীয় শত্রু বানাতে হবে। হাসিনার তৈরি ন্যারেটিভে শুধু জিয়া জাতীয় শত্রু নয়, ভাসানী ও তাজউদ্দিনও অদৃশ্য। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় প্রধান এ কে খন্দকারও জাতীয় শত্রু হয়ে যান।

আজ মুজিবের মূর্তি ভাঙা হচ্ছে, তা মুজিবের প্রতি আক্রোশ থেকে নয়; তা হচ্ছে হাসিনার তৈরি করা মুজিব কাল্টের প্রতি আক্রোশ থেকে। আজ পনেরোই আগস্ট যদি ছাত্র জনতা বাধ্যগতভাবে শোকাভিভূত না হয় তার কারণ মুজিব নন। মুজিব চরম মূল্য দিয়ে চলে গিয়েছেন—তার প্রতি মানুষের ক্ষোভ নেই। আজকের শোকের প্রকাশ ফিকে হয়ে গেছে শেখ হাসিনার মুজিব কাল্ট নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে। অনেকেই দেখেছি, ৫০ বছর আগের হত্যাকাণ্ডের জন্য শোক প্রকাশ করছেন কিন্তু সাম্প্রতিক মাসের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তারা একটিও কথা বলেননি। এর মানে তারা এমন একটি বাদ বা ইজমে বিশ্বাস করেন যা প্রটেক্ট করার জন্য প্রয়োজন হলে শত শত তরুণকে হত্যা করতে হবে। এই হত্যাকাণ্ডগুলো তাদের কাছে নেসেসারি। সুযোগ পেলে তারা আবারও এগুলো করবেন।

এই ১৫ আগস্টের অঙ্গীকার হোক, সেই ভালোবাসার মুজিবকে ফিরিয়ে আনা আর হাসিনার মুজিব কাল্ট থেকে দেশকে মুক্ত করা।

© fb/rumi.ahmed.31